আশায় বেধেছি বুক নিরাশার তীরে – গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্টঃ একটি সমীক্ষা
ড. আব্দুল আজিজ তকি

ভুমিকা
ঝাড়া পয়ত্রিশ বছর সেচ্চাসেবী সংগঠনের সাথে কাজ করে যে অভিজ্ঞতায় অধম পরিপূর্ণ তাতে তিক্ততা আর রুচিহীনতা ছাড়া উত্তম তেমন কিছু নেই। এই সেক্টেরের ‘নিমতলা’ আর ‘তাল তলা’ কেমন সে জ্ঞাণে নিজে মোটামুটি সম্মৃদ্ধ এ কথা বলতে পারি। এই পয়ত্রিশ বছরের কাজে – মাথা ন্যাড়া, ঘাড় তেড়া, আঙুল বাঁকা আর চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। ফলে নিজেকে নিজেই নোটিশ দিয়ে রেখেছিলাম যে আর এপথে পা বাড়াবোনা। অতিতের সব জঞ্জাল ঝেড়েফেলে, হাতমুখ ধুয়ে কয়েকটা দিন ধর্মকর্ম করে এ বিশ্ব থেকে বিদায় নেব। বল্লেই যে জীবনে ইচ্ছেমত সবকিছু করা যায়না সে আরেক মামলা। গান্ধিজীর একটা কথা মনে হল, তিনি বলেছিলেন ‘The best way to find yourself is to lose yourself in the service of others.‘ (নিজেকে আবিষ্কার করার সবচেয়ে ভাল পন্থা অপরের সেবায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা)। সেবার কাজটাইতো আমার জীবনের ব্রত। বাবাই সে তালিম শিশুলগ্নে দিয়েছেন। তারপর স্কাউটিং করে করে বড় হয়েছি। সুতরাং সেবাকর্ম ছাড়ি কেমনে।
অনুজ আনোয়ার শাহজাহান (লেখক ও সাংবাদিক) দেশে বিদেশে পরিচিত মহলে পরিচিত মুখ। একদিন টেলিফোন করে গোলাপগঞ্জের জনগনের জন্য কিছু ভাল কাজ করার প্রস্তাব দিলেন। প্রসঙের প্রারম্ভেই ‘তামাকের বড় কলকেটা’ আমার হাতে তুলে দিয়ে একটা নতুন সংগঠন জন্মাবার প্রস্তাব উত্থাপন করলেন । দেরি না করেই বলে দিলাম – আমি নেই, অতিতের জঞ্জাল আর ঘাটাতে চাইনা। নিজের খেয়েপরে খামোকা কিছুসংখ্যক মানবসন্তানের নিন্দাভাজন আর দিলের কাঁটা হতে চাইনা। সাফসাফ জানিয়ে দিলাম – সাহায্য, সহযোগীতা নিতে চাইলে দিতে পারি (যদি তেমন কিছু দেয়ার থাকে) কিন্তু ‘সভাপতি’ হয়ে নিজের সর্বনাশ করতে পারবোনা- আমি আউট। শাহজাহান এবার নিজের প্রস্তাবটা নিজেই প্রত্যাহার করে, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখের প্রথম সাংগঠনিক সভায় একটিবার উপস্থিত থাকার অনুরোধ করলেন। সভায় স্ব-শরীরে আরো যারা উপস্থিত থাকার সম্মতি দিয়েছেন তাঁদের কয়েকজনের নামও প্রকাশ করলেন। এ সকল শ্রদ্ধাভাজনরা নাকি আমি অধমের উপস্থিতি দেখলে খুশী হবেন। ভাবলাম এত বড় ইজ্জত পেয়ে উপস্থিতিতে অসম্মতি জানালে বড় ধরনের বেয়াদবী হয়ে যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে, আনোয়ার শাহজাহানের কথায় মুগ্ধ হয়ে মনস্থির করলাম আরেকটা চ্যান্স নিয়ে দেখি কি হয়। আমি একজন হাত গুটালেইতো পৃথিবী অচল হয়ে বসে থাকবে না অথবা অচল পৃথিবী একবারে সচল হয়ে যাবেনা। আনন্দে নিরানন্দে, ভাল-মন্দে, ঐক্যে-অনৈক্যে দিন যাবে, কাল আসবে।
অতিতের অভিজ্ঞতা আর জঞ্জালের কথা মাথায় রেখেই মিটিং এ হাজিরা দিলাম। আসলেই বেশ কিছু ভাল মুখ ও জানাশোনা গুণীজনদের দেখে কিছুটা স্বস্থি পেলাম। সংগঠনের আদর্শ উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তর আলাপ হল। সব আলাপই যুক্তিযুক্ত। বুঝা গেল সকলেই ‘সমষ্ঠিকল্যাণ’ ও ‘পরহিত’ করার মানসে মজবুদ বন্ধন চান। আরো দশ পাঁচটা সংগঠনের ইতরামি চিত্র তুলে ধরে অনেকে আবার বক্তৃতাও করলেন। উপস্থিত সকলেই যে কোন ধরনের আত্মঘাতি প্রবনতা থেকে অবমুক্ত থেকে একটা স্বচ্চ ও সু-সংহত সংগঠন করতে চান। শ্রুতিমধুর কথাগুলো কান ভরে শুনলাম, ভালই লাগলো। ভাবলাম এ ধরনের সংগঠনের শুরুটা সর্বদাই সরস ও মধুর থাকে কিন্তু শেষটা খুব একটা আনন্দের হয়না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই দেখে বলেছিলেন ‘ আমরা শুরু করি কিন্তু শেষ করতে পারিনা’। তারপরও আশায় বুক বাঁধলাম ‘যদিবা ঝড়ে বগলা মরে’ সমাজের কিছু ভাল কাজ হয়ে যায়।
প্রথম সভাতেই সিদ্ধান্ত হল সংগঠনের নাম হবে ‘ Golapganj Trust (UK) (পরবর্তিতে আমার অমতে ও বেশীরভাগ সদস্যদের মতামতে নাম বদল করা হয়েছে Golapganj Upazila Social Trust (UK))। ৩১ ডিসেম্বর ১০১৭ ইংরেজীর সভায় প্রথম একটা আহবায়ক কমিটি গঠন করা হল। উপস্থিতির তালিকায় একমাত্র মহিলা সদস্য ড. রেণূ লুৎফার (রেণু আপা) কাঁধে আহবায়কের দায়িত্বটা¡ মোটামুটি জুর করে তুলে দেয়া হল। না করেও তিনি অব্যাহতি পেলেন না। আমি খুশীর পর খুশী। এইবার একজন অভিজ্ঞ মানুষ পাওয়া গেল। কাজ হবে এবং কাজ করাও যাবে। হায় হায় পরে দেখি আমারও রেহাই নেই। একটা সংবিধান তৈরীর দায়িত্ব নিতে হল।সকলের বিশ্বাস আমি এ কাজের জন্য উপযুক্তজন।উপযুক্ত কিনা জানিনা । মনে হল এমনি করে ‘ Golapganj Helping Hands (UK) এর সাবেক সভাপতি সায়াদ আহমদ ছাদ সংগঠন সৃষ্টির প্রাক্কালে একটা যুৎসই সংবিধান তৈরী করে দেয়ার অনরোধ করেছিলেন। দিয়েছিলাম। পরে জানলাম এই সংবিধান প্রণয়নের কৃতিত্বটা কেউ কেউ হরণ করে নিয়ে গেছেন। এতে আমার ক্ষোভ দুঃখ কোনটাই নেই। সমাজ জীবনে কতশত বেহায়াপনা আর বেলাল্লাপনা দেখে অভ্যস্থ সুতরাং সেই তুলনায় এটা তেমন কিছু নয়। একটু ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে আমার তৈরী কোন কিছুর উপর ভর করে আমার ভাই/ভাইয়েরা যদি কিছুটা মান-সন্মান অর্জন করতে পারে তাতে আমি নাখুশী হওয়ার কি আছে। আমি মনে করি এতে আমারই গৌরব।
বিষয় হল, সংবিধানে সংগঠনের উদ্দেশ্য সহজে নির্ধারন করা গেলেও সাংগঠনিক কাঠামো তৈরী করাটা কঠিন। সব গন্ডগুলের আসল কেন্দ্রস্থল এখানেই। কারণ বেশীরভাগক্ষেত্রে দেখা গেছে যারা এ ধরনের সংগঠন সৃষ্টিতে প্রধান ভুমিকা নেন, তাদের সর্বোচ্চাশাটা থাকে পদ পদবী নিয়ে ‘অমরত্ব’ লাভ। উদ্দেশ্য সাফল্যে এরা মন না দিয়ে সংগঠনের পদ পদবী নিয়ে লাগান হুলস্থুল। এমনকি সময়াসময়ে ধরেন যুদ্ধাংদেহী রূপ। এদের থামানো যায়না। অর্থবিত্ত্ব দিয়ে বাঙালকে হাই কোর্ট পর্যন্ত দেখিয়ে ছাড়েন।
ষাট এবং সত্তরের দশকে হাতেগুণা কিছু বাঙালি সংগঠন ব্রীটেনে বসবাসরত বাঙালিদের জীবন উন্নয়নে ভাল কিছু কাজ করেছে। আশির দশক থেকে দেখা গেল বাঙালিরা সংগঠন বাড়াতে ঝুঁকে পড়ছে। নব্বইয়ের দশক থেকে আস্তে আস্তে আরো বাড়লো এবং অদ্যাবদি বাঙালি সমাজে চলছে সংগঠন গড়ার জোয়ার। আন্তর্জাতিক সংগঠন, জাতিয় সংগঠন, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা, গ্রাম, মহল্লা, পাড়া এমনকি পারিবারিক সংগঠনে চারিদিক সয়লাব। এর পরও রয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন ইত্যাদি ইত্যাদি। একেকটা সংগঠনের প্রতিপক্ষ আবার দুই-পাঁচটা রয়েছে। বলা যায় ব্রীটেনের বাঙালি সমাজে বর্তমানে চলছে সংগঠন গড়ার প্রতিযোগিতা।
এতসব সংগঠনের শানে-নুযূলটা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বেশীর ভাগ সংগঠনই ‘গলা ধাক্কার’ ফসল। অর্থাৎ গলাগলি থেকে গালাগালি, মিল থেকে অমিল, শ্রদ্ধা থেকে শ্রাদ্ধ, ঐক্য থেকে অনৈক্য, আলাপ থেকে প্রলাপ করে যাদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন অথবা নিজেরা বের হয়ে যান তারাই হন নতুন সংগঠনের হোতা। এর পেছনে থাকে ব্যাক্তিস্বার্থ, সংকীর্ণতা, হীনমন্যতা ও পরশ্রীকাতরতা, ধৈর্য্যহীনতা ও সহিষ্ণুতার অভাব। কেউ কাউকে মানতে রাজি নয়। যে কারণে একটা মজবুদ সংগঠন গড়ে উঠেনা। পদ পদবীর স্বার্থলিপ্সা সংগঠনের সফলতাকে ও সংঘবদ্ধতার স্বপ্নকে বদ করে ফেলে। অ্যামেরিকার নামকরা একজন লেখিকা Laura Ingalls Wilder বলেছিলেন – ‘The trouble with organising a thing is that pretty soon folks get to paying more attention to the organisation than to what they’re organised for’ (কোনকিছূ সংগঠিত করার সমস্যা হল, খুব তাড়াতাড়ি লোকজন সংগঠনের প্রতি ঝুকে পড়ে কিন্তু কেন সংগঠিত হয়েছিল তা থাকে অদেখায়)। যে কারনে সংগঠনের সুফলতা ও বিফলতার বিষয়ে কিছু ব্যাক্তিগত অভিমত দিলাম। নিজের মিটা-তিতা অভিজ্ঞতাটা তুলে ধরলাম। সামাজিক সংগঠনে কাজ করতে করতে ভুতা হয়ে গেছি। বিশেষ করে, যে কারণগুলো আমাদের সংগঠনগুলোকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে তার কিছু নমুনা নীচে তুলে ধরলাম। আশাকরি সুহৃদ পাঠকরা সহ্য করবেন। নিশ্চয়ই এগুলো শেষ কথা নয়, আরো আছে। হরহামেশা নতুন আরো কত কিছু আসবে সেজন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
সর্বনাশের মূল কারণ :
উচ্চাশা (Ambition): সর্বক্ষেত্রেই দেখা গেছে সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ কোন তর্ক বিতর্ক করেন না এমনকি আরো পাঁচ-দশজনকে ডেকে নিয়ে এসে সংগঠিত হওয়ার চেষ্ঠা করেন। কিন্তু কিভাবে সুসংহত থেকে একটা সংগঠনের কাজকে চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা জানেন না অথবা জানা থাকলেও তা মানেন না। কারণ ‘গণ্যমান্য’ হওয়ার একটা চুড়ান্ত বাসনা নিয়ে তারা যাত্রা ধরেন। এমন উচ্চাভিলাষ নিয়ে যারা সামাজিক সংগঠনের হাল ধরেন কিংবা ধরতে চান তাদের কাছে ক্ষমতার লালসা থাকে প্রকট। বুদ্ধি থাকুক আর নাইবা থাকুক তারা ক্ষমতার মগডালে লাফ দিয়ে ওটে নিজেকে গণ্যমান্য দেখাতে চান। কিন্তু বুদ্ধিদিয়ে বুঝতে পারেন না যে এমন লাফালাফি শাখামৃগদের ভাই বেরাদরেরাই করে থাকে। ইংরেজীতে একটি কথা আছে `It’s nice to be important, but it’s more important to be nice` (গণ্যমান্য হওয়াটা সুন্দর কিন্তু সুন্দর হওয়াটা আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ)।নিজেরা গণ্যমান্য হওয়ার জন্য জান-মাল বিসর্জন দিতে প্রস্তুত কিন্ত সুন্দর ও সাদা মনের মানুষ হতে বড়ই খঞ্জুস। যে কারনে নিজের উচ্চাশা পুরণে একে অপরের পেছনে লেগেই থাকেন আর এদিকে সংগঠনের বারোটা বাজতেই থাকে।
দায়বদ্ধতা (Commitment): সকলেই একমত, সহমত নিয়ে কাজে নামেন।হাত পা যে ভাবে নাড়ান মনে হয় তাদের কাছে ‘এপার- ওপার’ সে কোন কঠিন বিষয়ই নয়। কিন্তু একটা সংগঠনের সদস্য হলে যে দায়বদ্ধতা কাঁধে নেন সে সম্পর্কে তিল পরিমান জ্ঞাণ দেখাতে পারেন না। ‘তিলকে তাল আর তালকে তিল’ বানিয়ে লাগান গন্ডগোল। ফলে, শেষ পর্যন্ত সংগঠনটাই পড়ে সমুহ ক্ষতির সন্মুখীন। অথচ নিজের দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করলে একটা সংগঠন মেলাদিন মান সম্মান নিয়ে চলতে পারে। অ্যামেরিকার একজন ফুটবলার ও সুবক্তা Inkey Jonson দায়বদ্ধতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন – Even when you don’t feel like showing respect, you get your butt up and you show respect anyway. That is what commitment is, and commitment will take you a long way in life. (এমনকি তুমি যদি মনে কর শ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছেনা তারপরও তুমি মুখটা উচু করে শ্রদ্ধা দেখাও এটাই তোমার দায়বদ্ধতা, আর এই দায়বদ্ধতাই তোমাকে জীবনে অনেক দূর নিয়ে যাবে)। যারাই একটা সমিতির দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজে নামেন তাদেও জিজ্ঞাসা করি- ভাই একটিবার বুকে হাত দিয়ে বলেন কে কতটুকু কান্ডজ্ঞাণ রেখে সে দায়বদ্ধতাকে আঞ্জাম দিলেন!সংগঠন থেকে আপনি বড় পদ-পদবী পেলেন পরিবর্তে কি দিয়ে গেলেন? নিজে নিজে হিসাব করে দেখান না – আপনার মেধা আর মননশীলতা সংগঠনের কামকাজে কতটুকু কল্যান এনে দিল? সংগঠনগুলোতে দেখা যায় কেউ কারো প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে পারে না বলেই নিজেদের ভেতর সর্বদা লেগে থাকে গন্ডগুল। বলতে দ্বিধা নেই , এমনতর ‘গলাধাক্কার’ কোন সংগঠনই এ ব্যাপারে সচেতন নয়। যে কারণে এসব সংগঠনে দেখা যায় ‘বার জন ব্রাম্মনের তেরোটা হুক্কা’। ফলে সংগঠন হয় কপোকাৎ।
দায়ীত্ববোধ (Responsibilities): অতি বুদ্ধির পরিচয় দিতে গিয়ে বাঙালীরা ‘ইতি জ্ঞাণ’ হারিয়ে ফেলে। পদ-পদবী নিয়ে সকলেই হরহামেশা ধাক্কাধাক্কি করে অথচ যে পদ অলংকৃত করে নিজেদের একটা কিছু ভাবেন সেই পদের মান সম্মানটা কি শেষ পর্যন্ত রাখতে পারেন? পদধারী হিসেবে তার দায়ীত্বগুলো পালনে কতটুকু ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা দেখাতে পারলেন এবং সংগঠনের সফলতায় কতটুকু অবদান রাখতে পারলেন সে প্রশ্নটা কখনো করেন না। এই দায়ীত্ববোধটা হচ্ছে আবশ্যকীয় শিক্ষা এবং এ শিক্ষা হঠাৎ হয় না। সামাজিক সংগঠনের বেশীর ভাগ কর্মকর্তাদের সে জ্ঞাণ নেই। এ জ্ঞাণ যে নেবেন তারও ইচ্ছা তাদের থাকেনা। সকলেই মনে করেন ‘সবজান্তা’। এই সব ‘সবজান্তাদে’র কবলে পড়ে আর যাই হোক সংগঠন কোনভাবেই সুস্থ ও স্বাস্থ্য সম্মত থাকতে পারেনা। এরাই বার বার দায়ীত্বহীনতার পরিচয় দেয় এবং ক্ষমতার বাহাদুরী দেখিয়ে সংগঠনের ঐক্য রক্ষা করার চেয়ে ঐক্য নষ্ট করে। ক্ষমতা প্রয়োগ আর বুদ্ধির পরিচয় সমান নয়। সংগঠনের ভিতরের বিষয় ভিতরেই সমাধা করতে হয়, যা সচরাচর হয় না। যে কারনে কলম চালিয়ে অনেকে নিজেদের বুদ্ধিমান মনে করে এবং পেপার পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করে দেয়। আসলে এরাই নির্বোদ ও বোকা। নিজেরা কিছু করার সামর্থ রাখেনা আর অপরকেও ভাল কিছু করতে দেয় না। এদেও দায়ীত্বহীনতাই সংগঠনের সর্বনাশ ডেকে আনে। প্রয়োজনে এরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগঠনের মুল কমিটিকে তোয়াক্কা না করেই আরেকটি কমিটি কিংবা সংগঠনের সাথে মিল রেখে আরেকটি সংগঠন করতেও উঠেপড়ে লাগে।
অক্ষমতা (Incapabilit) : অধ্যাপক আবু সাঈদ বলেছেন ‘অক্ষম মানুষ সাধারনতঃ ব্যর্থ হয় আর ব্যর্থ মানুষ হয় পরশ্রীকাতর’। যে সকল শ্রীমানরা সামাজিক সংগঠনের একটা পদ পদবী ধরতে পাগল হয়ে অর্থবিত্ত্ব দিয়ে ঝাপ দেন, কামের চেয়ে নাম কামানোটাই যাদের একমাত্র স্বপ্ন (সকলের বেলা নয়), এমন মানুষগুলো নিজেদের অক্ষমতা বুঝতে পারে না। তারা যখন অনুভব করে নিজেরা কিছু করতে পারছে না তখন আর সহনশীল থাকতে পারে না। নিন্দুকের ভূমিকা নিয়ে সংগঠনটাকে করে ফেলে ‘নিন্দবাদের বৃন্দাবন’। অযথাই বলে বেড়ায় ‘চেয়াম্যান হাজার হাজার টাকা খেয়ে ফেলেছে’ অমুক এই করেছে, তমুক সেই করেছে। অর্থাৎ মিথ্যা তহমৎ তুলে চাইবে অন্যান্যদের ঘায়েল করতে। অক্ষমদের এই নেতিবাচ অভিশাপ সংগঠনের চালিকাশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। অক্ষমদের এমন অপবাদের মুখে পড়তে কোন কোন সক্ষম কখনো পা বাড়ায় না। যে কারণে সামাজিক সংগঠণ গুলোতে সক্ষম মেধাবানদের উপস্থিতি থাকে নিতান্ত কম। দু একজন যারা আসে তারাও সহজে ঠিকতে পারেনা, ইজ্জৎ নিয়ে দেয় দৌড়।
সংকীর্ণতা (Narrowness) : যারা নিজেদের অস্থিত্যকে অপরের কাছে জাহির করতে চায় তাদের বেশীর ভাগই যে পথ অবলম্বন করে সে পথটি থাকে খুবই কদর্য। নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তারা যে কাজগুলো করে সেগুলো হল, দল পাকানো, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা। নিজেদের আত্ম স্বার্থের জন্য টাকা পয়সা খরছ করে দল ভারি করে ভোট সংগ্রহে থাকে মনযোগী। এলাকা, পাড়া প্রতিবেশীর এমনকি পরিবারিক আপনজনদের সংগঠনে টেনে এনে হয় দলে ভারী। ফলে ভাল মানুষগুলো আর সংগঠনে ঠিকতে পারেনা। এমন সংকীর্ণ স্বার্থপরতা সংগঠনের জন্য বিরাট ক্ষতিকর। এদের মানসিকতাই হল ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা আকড়ে ধরা। ক্ষমতা নিতে না পারলে দেয় ‘মরণ কামড়’। সংবিধানের কাঠামো দিয়ে এদের বারণ করা কঠিন। যে পথই ধরেননা কেন তারা সেই পথের কাঁটা হয়ে অপরকে ঘায়েল করবেই। এদের কাছে সংগঠনে মিলের চেয়ে যত বেশী অমিল হবে ততই ভাল। আর এ কাজগুলোকে তারা নিজেদের গৌরবের ও অহংকারের বিষয় মনে করে। এতে সংগঠন হয় লন্ডভন্ড ও ধরাশায়ী।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা (Longterm Vision) : একটা সংগঠনের জন্য সবচেয়ে বেশী দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরীকল্পনা, কঠোর নিষ্ঠা ও পরিশ্রম যার উপর ভিত্ত্বি করে সংগঠন এগুবে। প্রায় সংগঠনের দীর্ঘমেয়াদী কোন পরীকল্পনা নেই। সংগঠনের সাথে জড়ীতজনেরা এব্যাপারে বুঝেন কি না জানিনা। বুঝলেও নিজেরা কোন পদক্ষেপ নিতে দেখিনা। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কি করা দরকার তা নিয়েও বড় কোন পরামর্শ হয় না। পরীকল্পনাহীন সংগঠন তালবিহীন সঙ্গীত আর তলাবিহীন ঝুড়ির মত। প্রায় সকল সংগঠনকেই দেখা যায় উৎসব মুখর। ‘ইফতার পাটি’ ‘সংবর্ধনা’ ‘পিঠামেলা’ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। উৎসব থাকবে অবশ্যই কিন্তু এগুলো যে সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য নয় এ কথাটা বুঝাবে কে। একটা শিক্ষা ট্রাস্ট যখন ভাল ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি দেবে বলে লক্ষ টাকা খরছ করে মিনিস্টার আর এমপি এনে নিজেদের ফটো ছাপাকরে প্রচারে নামে তখন মা সরস্বতি ‘কাশী যাই না মক্কায় যাই’ ভেবে পান না। শিক্ষা প্রসারে এমন কাজ কী ভুমিকা রাখে আমি খোঁজে পাই না। শুধু কাজ করলেই হয় না, সংগঠনের একটা পরিকল্পনা থাকতে হয় যে পরিকল্পনা তৈরী হবে সকলের স্বপ্ন ও বিশ্বাসের উপর। ফরাসী সাহিত্যিক Anattole France বলেছেন ‘ K Anatole Fiance ‘ to accomplish great things, we must not only act, but also dream; not only plan but also believe` (কোন মহান কিছু সু-সম্পন্ন করতে অবশ্যই স্বপ্ন থাকা চাই শুধু কাজ নয়, পরিকল্পনার সাথে বিশ্বাসও রাখতে হয়)।
এখানে আমি যে বিষয়গুলো তুলে ধরলাম এগুলো আমার চোখে দেখা কিছু দুর্গতী সম্পন্ন সংগঠনের কালচিত্র থেকে নেয়া। আমার বিশ্বাস যারা নিয়ত সংগঠন করেন তাঁদের জ্ঞাণ আমার চেয়ে বহুগুণ বেশী। Golapganj Upazila Social Trust (UK) এ যারা যুগ দিয়েছেন তাঁরা নিজেদের সচেতনা দিয়েই কাজ করবেন এ আশা রাখি। ধৈর্য্য হারাবেন না বলে আমার বিশ্বাস। নিজের আতœসার্থের জন্য জনসার্থকে জলাঞ্জলী দেবেন না। সংগঠন থেকে যখন যে পরিকল্পনাই নেয়া হবে সেগুলো হবে সকলের সমর্থনযোগ্য ও সুদূর প্রসারী।সকলেই সুন্দর স্বপ্ন দেখবেন, স্বপ্ন দেখাবেন ও স্বপ্ন নিয়ে সকল সংকীর্ণতার উর্দ্ধে থেকে কাজ করবেন। সমস্যা আসবে, সকলে সহনশীলতা নিয়ে সমাধান খোঁজবেন। মনে রাখতে হবে কেউই ‘সবজান্তা’ নয়। একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করলে সংগঠনের সম্মান বাড়বে আর সেই সাথে সংগঠনের সাথে জড়ীত সকলেই সম্মানিত হবে। না জানাটা বোকামী নয়, জেনে নেয়ার নামই বুদ্ধিমত্ত্বা, সুতরাং যেখানে আমাদের জানার কমতি আছে সেখানে জানার চেষ্ঠা করবো। একে অপরের প্রতি সম্মান ও বিশ্বাস রাখতে পারলেই সংগঠন সুস্থ ও সুন্দর থাকবে। দায়ীত্বহীনতা যেন কোনভাবে আমাদের গ্রাস না করে। সকলের সম্মিলীত প্রচেষ্ঠায় আমরা যেন একটা ‘মডেল’ সংগঠন গড়তে পারি। আমাদের গৌরব ও অহংকার দেখে অন্যরা যেন মাথানত করে- ‘এই আশায় বেধেছি বুক নিরাশার তীরে’।
ড. আব্দুল আজিজ তকি : লেখক ও কলামিস্ট। দীর্ঘদিন থেকে কাউন্সিলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সহ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য। বর্তমানে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
