রুহুল আমিন রুহেল
ভাইস চেয়ারম্যান, গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে।
মানুষ সামাজিক জীব। যুগ যুগ ধরে মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সংগঠনের নামে সেবা দান করে যাচ্ছে। মানবজীবনে সামাজিক সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। একই সমাজ ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্য প্রতিটি সংগঠন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি সংগঠন আমাদের একে অন্যের এতটাই কাছে নিয়ে আসে যে মনে হয় আমরা একটি পরিবার। পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সামাজিক সংগঠনের কোনো বিকল্প নেই। বড় পরিসরে সমাজকে কিছু দিতে হলে সমষ্টিগতভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
বিলেতে গোলাপগঞ্জ উপজেলাভিত্তিক যে কটি সংগঠন আছে, সেগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলাদা। কেউ শিক্ষা নিয়ে, কেউ দারিদ্র্য বিমোচনের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশকে সামনে রেখে সবাই নিজ নিজ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি সংগঠন। আমাদের প্রতিটি কার্যক্রম বিলেতভিত্তিক। বর্তমান প্রজন্মকে আমাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে এ ধরনের একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যাঁরা বিলেতে এসেছিলেন, তাঁদের চিন্তাধারার সাথে বর্তমান প্রজন্মের কোনো মিল নেই বললেই চলে। সময়ের ব্যবধানে দিন দিন এই দূরত্ব বেড়েই চলেছে। আমরা যারা দুই বা তিন দশক আগে বাংলাদেশ থেকে এসেছি তারা প্রায় সবাই এখনো বাংলাদেশি হয়েই বিলেতে বসবাস করছি, কিন্তু আমাদের এই প্রজন্ম পূর্বসূরিদের মাতৃভূমি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখে না।
শত ব্যস্ততা ও প্রতিকূলতার মাঝেও আমরা মা-মাটি-মানুষকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকতে পারি না। আমরা যারা সামাজিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত, আরো পঞ্চাশ বছর পরে হয়তো তাদের অধিকাংশই এই পৃথিবীতে থাকব না; তখন এই সংস্কৃতি কে লালন করবে; আমাদের কথা অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কে নিয়ে যাবে? এই চিন্তা মাথায় রেখেই বিলেতভিত্তিক এই সংগঠন গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে প্রতিষ্ঠা করেছি। এই প্রজন্মকে দেশ ও দেশের সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের। আসুন সবাই মিলে সংগঠনটিকে এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরি এবং প্রমাণ করি যে আমরা সত্যিকারের খাঁটি বাঙালি, আমরা জন্মভূমিকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসি।
এ ধরনের একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু আপনারা ভেবে দেখবেন। সময়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আমরা একদিন হারিয়ে যাব, আমাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবে। সোশ্যাল ট্রাস্টের এই নতুন ও অভিনব যাত্রা ইতোমধ্যে সবার আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে অনেকেই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন, যার ফলে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে তিন শতাধিক সদস্য সংগ্রহ করার গৌরব অর্জন করেছি, যা অন্য কোনো সংগঠনের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে আমরা শুধু আমাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি, এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সংগঠন থেকে সব সময় দূরে রাখি বলেই আমাদের সন্তানেরা এ ধরনের একটি সংগঠনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না। আমরা যারা সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত, তারা একে অন্যকে ছাড়া আর কাউকে জানাতে পারি না। এতে করে এই প্রজন্মকে আমরাই আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে সুন্দর একটি মাধ্যম হচ্ছে গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট। সামাজিক সংগঠনের সাথে এই প্রজন্মকে সংযুক্ত করার মহামন্ত্র হচ্ছে এই সংগঠন।
সংগঠনটিকে গ্রহণযোগ্য একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে হলে সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। সেই সাথে বড় মাপের পরিবর্তন নিয়ে আসতে হলে সার্বিক অনুশীলন খুবই জরুরি।

শুরু থেকে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সংগঠনটিকে নতুন আঙ্গিকে সবার কাছে উপস্থাপন করতে, যাতে আমাদের এই প্রজন্ম আমাদের জানতে পারে বুঝতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের এ সংগঠনের দায়িত্ব অর্পিত হবে এই দেশে বেড়ে ওঠা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর, তাই আমাদের সবার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। সংগঠনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখলেই দায়িত্ব পালন করা হয় না; সংগঠনের নেতৃত্ব যাদের হাতে, তাদের দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী হতে হয়। আমার বিশ্বাস, সোশ্যাল ট্রাস্টের প্রত্যেক সদস্য এই সুন্দর ও দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই সংগঠন বিলেতের বুকে আজীবন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ঝলমল করে বিশ্বের দরবারে আমাদের আরো সম্মানিত করবে। গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে আমাদের এক সুতায় বেঁধে রাখুক; সমগ্র জাতির কাছে উদাহরণ হয়ে থাকুক।
প্রতিটি সংগঠনের শুরুটা বেশ কঠিন হয়ে থাকে, আমরাও সেই কঠিন সময়ের কবলে পড়েছিলাম। নতুন আরো একটি সংগঠনের জন্ম হোক, এটা অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারেননি। ফলে অনেকেই আমাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। দূর থেকে অনেক কিছুই বোঝা যায় না। লোকমুখে শোনা কথা নিয়ে অনেকেই আমাদের সংগঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় সেই সমস্যা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আমাদের সংগঠনের সংবিধান যাঁরা পড়েছেন, সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে এ সংগঠনের সাথে গোলাপগঞ্জের অন্য সংগঠনগুলোর মতপার্থক্য থাকার কোনো অবকাশ নেই। গোলাপগঞ্জ উপজেলা এডুকেশন ট্রাস্টের নামের সাথে সাদৃশ্য থাকায় অনেকেই মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। সংগঠন সবাইকে ধরে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয়, দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য নয়। সংগঠনের নাম পরিবর্তনের জন্য আমাদের অনুরোধ করা হয়েছিল। সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য এই প্রস্তাব যখন আমাদের কাছে আসে, তখন আমরা তা সাদরে গ্রহণ করি। আমাদের প্রথম সাধারণ সভায় ‘গোলাপগঞ্জ ট্রাস্ট’ নামের পরিবর্তে ‘গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট’ নাম আমি নিজে প্রস্তাব করি এবং সেটি অধিকাংশ উপস্থিতির সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। নাম পরিবর্তন নিয়ে সোশ্যাল ট্রাস্টের তৎকালীন সদস্য সচিব ও বর্তমান জেনারেল সেক্রেটারি আনোয়ার শাহজাহান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সত্যি কথা প্রকাশ করতে দ্বিধা নেই, সংগঠন প্রতিষ্ঠাকালে যত ধরনের সমস্যা ছিল, আনোয়ার শাহজাহান সেগুলো ধৈর্য, ও বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করেছেন।
তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট সবার কাছে আস্থা ও বিশ্বাসের মতো একটি সংগঠনে পরিণত হয়। এমনকি গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ব্রিটেনে প্রথম সংগঠন, যেটিতে দেড় বছরের মধ্যে তিন শতাধিক সদস্যের সংগঠনে পরিণত হয়েছে। আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে আনোয়ার শাহজাহানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সংগঠন প্রতিষ্ঠাকালীন আরেকটি নাম উচ্চারণ না করলেই নয়, তিনি হলেন আমাদের সাবেক আহ্বায়ক ও বর্তমান উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ডক্টর রেনু লুৎফা। এ ছাড়া গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর মোহাম্মদ আব্দুল বাছিত খুবই শক্ত হাতে সংগঠনের হাল ধরেছেন। দিনরাত পরিশ্রম করে সদস্য সংগ্রহ করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। আমি ডক্টর রেনু লুৎফা ও মোহাম্মদ আব্দুল বাছিতকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সংগঠনের শুরুটা সব সময় কঠিন হয়ে থাকে, এ কথা আমি আগেও বলেছি। তাই কঠিন সময়কে সহজ করার জন্য আমাদের অনেক সময় বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। সংগঠনের শুরুটা যাঁদের হাত দিয়ে হয়ে থাকে, তাঁদের মধ্য থেকেই চেয়ারম্যান বা জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয়। আমি যেহেতু একেবারে শুরু থেকেই এ সংগঠনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম, তাই সবাই ভেবেছিলেন আমিই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হতে পারি। বেশ কয়েকজন আমাকে এই পদ অলংকৃত করার জন্য উপদেশও দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি নীতিগত কারণে হ্যাঁ বলতে পারিনি। আনোয়ার শাহজাহান ও আমি একই এলাকার মানুষ, ফলে বিষয়টি আমার কাছে সার্বজনীন মনে হয়নি। তাই তৃতীয় কাউকে দিয়ে যাত্রা শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর সাধারণ সভায় বোর্ড অব ম্যানেজমেন্ট কমিটি এবং ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ইসি কমিটি গঠনের পর সোশ্যাল ট্রাস্টকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আরো অনেকেই নিজের সময় ও অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছেন, যাঁদের নাম প্রকাশ করাও আমার নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ জহির হোসেন গৌছ, মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, বদরুল আলম বাবুল, তারেক রহমান ছানু, সালেহ আহমদ, রায়হান উদ্দিন, মো. নুরুল ইসলাম প্রমুখ। এসব নিবেদিত প্রাণের সহযোগিতা ছাড়া এ সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। এক ঝাঁক উজ্জ্বল মানুষের পরশে আজকের গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আমি তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
লেখক পরিচিতি : কথাসাহিত্যিক ও গীতিকার রুহুল আমিন রুহেলের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭। ‘আমাদের প্রতিদিন’ অনলাইন পোর্টালের প্রধান সম্পাদক। গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান। জন্ম ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের দত্তরাইল গ্রামে।
#লেখাটি প্রথম ‘গোলাপগঞ্জ উৎসব ২০১৯’ উপলক্ষে প্রকাশিত গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্টের স্মারকগ্রন্থ ‘প্রজন্মের সেতু’ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকাল জুলাই ২০১৯।

