
তছউর আলী
প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক, লন্ডন বাংলা স্কুল
প্রবাসে বেড়ে ওঠা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময়ই একটা চিন্তা ঘুরপাক খায়— “তারা কি একদিন আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ইতিহাস ভুলে যাবে?”
এই প্রশ্নটা কেবল আবেগের নয়, বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব আর চারপাশের পরিবেশ—সব মিলিয়ে আমাদের সন্তানেরা ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা ও পরিচয় থেকে সরে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা থেকেই জন্ম নিয়েছে লন্ডন বাংলা স্কুল। এটি শুধু একটি স্কুল নয়, বরং শিকড়ে ফেরার পথ, আত্মপরিচয় রক্ষার সংগ্রাম আর নতুন প্রজন্মের জন্য এক সাংস্কৃতিক জাগরণ।
এই স্বপ্নের রূপকার আমার ছাত্র আনোয়ার শাহজাহান। তিনি শুধু লেখক ও সাংবাদিকই নন, একজন সাহসী সংগঠক এবং বর্তমানে গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে-এর চেয়ারম্যান। একদিন তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, “স্যার, আমাদের একটি বাংলা স্কুল দরকার। আপনি যদি প্রধান শিক্ষক হন, আমরা একসঙ্গে অনেক দূর যেতে পারব।” আমি এক মুহূর্তও চিন্তা না করে বলেছিলাম, “এমন একটি মহৎ উদ্যোগে অংশ নেওয়া আমার জন্য গর্বের।”

তারপর থেকেই শুরু হয় আমাদের প্রস্তুতি। ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট, পূর্ব লন্ডনের এক সংবাদ সম্মেলনে লন্ডন বাংলা স্কুল-এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। মাত্র ১৮ দিন পর, ১৬ সেপ্টেম্বর, পূর্ব লন্ডনে কয়েকজন আগ্রহী অভিভাবক ও শিশুকে নিয়ে শুরু হয় আমাদের পাঠদান।
প্রথম দিন থেকেই আমরা বাংলা ভাষাকে আনন্দের মাধ্যমে শেখানোর পদ্ধতি গ্রহণ করি। আনোয়ার শাহজাহান নিজেই একটি নতুন পাঠ্যবই তৈরি করেন—‘লন্ডনে বাংলা বর্ণমালা’—যা ইংরেজিভাষী শিশুদের উপযোগী করে সাজানো। অভিভাবকদের অভিমত অনুযায়ী, এই বইটি বাংলা শেখার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হয়ে উঠেছে।
আমাদের স্কুলের সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো—এখানে অনেক শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবী পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করছেন, নিঃস্বার্থভাবে সময় দিচ্ছেন। অভিভাবকেরাও শুধু সন্তান পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ নন, বরং স্কুলের পরিকল্পনা, কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন।
লন্ডন বাংলা স্কুল এখন একটি শিক্ষাকেন্দ্রের চেয়ে অনেক বড় কিছু। এটি একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র, যেখানে প্রবাসে বেড়ে ওঠা শিশুরা গর্বের সঙ্গে বলতে শিখছে—“আমি বাঙালি, আমি বাংলা জানি।”
আমরা গত ৫ জুলাই সফলভাবে আয়োজন করেছি শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সম্মাননা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে বাংলা স্কুলের প্রতি শিশুদের ভালোবাসা আর আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি ছিল স্পষ্ট। সেই দিন বুঝেছি, আমরা সঠিক পথে আছি।

এই যাত্রার নেপথ্যে আনোয়ার শাহজাহান ছিলেন আলোকবর্তিকা। তাঁর চিন্তা, পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব ছাড়া এ পথচলা সম্ভব হতো না। আমি তাঁর প্রতি অভিনন্দন জানাই।
আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পরিচালনা কমিটি, অভিভাবক, শিক্ষক এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে-এর সম্মানিত বোর্ডকে—যাঁরা আমাদের পাশে ছিলেন এবং আস্থার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো—একটি স্থায়ী স্কুল ভবন ও বাংলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা।
এই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব একমাত্র কমিউনিটির সকলের সহযোগিতায়। আমরা চাই—এই স্কুল শুধু পূর্ব লন্ডনে সীমাবদ্ধ না থেকে সারা যুক্তরাজ্যে বিস্তৃত হোক। প্রতিটি শহরে একটি করে লন্ডন বাংলা স্কুল থাকুক, প্রতিটি প্রবাসী শিশুর হাতে থাকুক বাংলা বই।
আপনাদের প্রতি আমার আন্তরিক আহ্বান— এই স্কুল কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি চেতনার নাম, একটি দায়িত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ। আসুন, সবাই মিলে ভাষা ও সংস্কৃতির এই আন্দোলনে অংশ নিই। আমরা চাই, আগামী প্রজন্ম বাংলাকে ভালোবাসুক, নিজেদের ইতিহাস জানুক এবং গর্ব করে নিজের পরিচয় ধারণ করুক।
আল্লাহ আমাদের এই প্রচেষ্টা কবুল করুন এবং লন্ডন বাংলা স্কুল-কে একটি মডেল প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন—এই দোয়া করি।
তছউর আলী
প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক, লন্ডন বাংলা স্কুল
সাবেক উপদেষ্টা
গোলাপগঞ্জ উপজেলা সোশ্যাল ট্রাস্ট ইউকে
